সংগীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সংগীত - তত্ত্বীয় | | NCTB BOOK

বাংলাগানের ইতিহাস

বিশ্বসংগীতের প্রাচীনতম সংগীতধারার মধ্যে অন্যতম 'বাংলাগান' এর যাত্রা শুরু হয় খ্রিস্টীয় দশম শতকে।
এর প্রথম নিদর্শন 'চর্যাগীতি' ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাগানে প্রধান সংগীতধারা হিসেবে
স্বীকৃত। ছোটো ছোটো পদে বিভক্ত চর্যাগীতির বিষয়বস্তু ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সাধুদের জীবনাচার। এই পদের
মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের নৈতিক তত্ত্ব প্রচার করতেন বৌদ্ধ সাধকরা। চর্যাপদের ভাষা ছিল
'সন্ধ্যাভাষা'। প্রাকৃত (সেই সময়ের কথ্য ভাষা) ও বিশুদ্ধ বাংলার সংমিশ্রণে রচিত এই পদসমূহের বৈশিষ্ট্য ছিল
এই যে, এগুলো ছিল দ্ব্যর্থবোধক। সাধারণের জন্য আপাত অর্থের বিপরীতে প্রত্যেক পদের একটি গূঢ় অর্থ ছিল
যা সহজিয়া সাধকগণই বুঝতেন। প্রত্যেক পদের উপরের শিরোনামে পদে ব্যবহৃত রাগের নাম এবং পদের
শেষে পদকর্তার ভণিতা ( ছন্দে ও সুরে গীত পদকর্তার নাম) থাকত। সাহিত্য ও সংগীত গবেষক
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে এই চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি
আবিস্কার করেন।

বাংলা সংগীতধারার পরবর্তী সংগীত গীতগোবিন্দ মূলত সংস্কৃতে লিখিত। কিন্তু বাংলার পরবর্তী সংগীত বিশেষ
করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং ভারত উপমহাদেশীয় নৃত্য-সংগীত-ধারার অনুপ্রেরণা ছিল গীতগোবিন্দ। গোবিন্দ
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ-এর জীবনের নাটকীয় ঘটনাই ছিল গীতগোবিন্দের বিষয়বস্তু। মোট বারো সর্গে বিভক্ত এই গান
পরবর্তী শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পূর্বসুরী। গীতগোবিন্দ রচনা করেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব।
গীতগোবিন্দের পরিবেশনায় গান করতেন জয়দেব এবং নৃত্যে সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী পদ্মাবর্তী।

বাংলাগানের ইতিহাসে গীতগোবিন্দের পরবর্তী ধারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিষয়বস্তু রাধা-কৃষ্ণের
জীবনলীলা। বাংলায় লিখিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতগোবিন্দের মতোই শ্রীকৃষ্ণের জীবননির্ভর ছোটো ছোটো
নাট্যদৃশ্যে ভাগ করা। তবে এখানে দৃশ্যকে সর্গ না বলে খণ্ড বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা হিসেবে চণ্ডীদাস
নামের ভণিতা (শেষ স্তবকে লিখিত রচয়িতার নাম) পাওয়া যায়। তবে চণ্ডীদাস নামের পূর্বে বড়ু চণ্ডীদাস, বীজ
চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ইত্যাদি বিশেষণ থাকাতে এবং আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কলেবর (আকার
পরিমাণ) বিবেচনা করে ধারণা করা হয় চণ্ডীদাস এক ব্যক্তি ছিলেন না বরং চণ্ডীদাস ছদ্মনামে বিভিন্ন সাধক
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন।

পরবর্তী ধারা বৈষ্ণব পদাবলি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরই ধারাবাহিক প্রকরণ। পদাবলি কীর্তন পূর্বতন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেরই
উত্তরধারা। বৈষ্ণব পদাবলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর কাব্যিক ভাষা। মিথিলার বৈষ্ণব সাধু বিদ্যাপতি তাঁর সংগীত
জীবন কাটান বাংলায়। বিদ্যাপতি মৈথিলী এবং বাংলাভাষার মিশ্রণে বৈষ্ণব পদাবলির জন্য গীতিকাব্যিক
ব্রজবুলি ভাষার অবতারণা করেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধারায় গীত বৈষ্ণব পদাবলি ষোড়শ শতকের
দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর নরোত্তম দাসের নেতৃত্বে আহুত খেতুরীর মহোৎসবে গরাণহাটি, রাণীহাটি, মন্দারিণী,
মনোহরশাহী এবং ঝাড়খণ্ডী এই পাঁচটি গীতধারায় বিভক্ত হয়। পঞ্চদশ শতকের বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য

নামকীর্তনের (পদাবলির গল্পভিত্তিক গান নয়, শুধু নাম ছন্দে ও সুরে গাওয়া) মাধ্যমে বাংলায় কীর্তন গানে
গীতবিস্তারের সূচনা করেন। বৈষ্ণবপদাবলি কীর্তনগান, বাংলায় পরবর্তী বিভিন্ন সংগীতধারা এমনকি হাল
আমলের সিনেমার গান ও ব্যান্ড সংগীতকেও প্রভাবিত করেছে।

বাংলাসংগীতের আরেকটি প্রাচীন আখ্যানধর্মী গীতধারা মঙ্গল গান। মঙ্গল অর্থে শুভ, যেকোনো মাঙ্গলিক শুভ

অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বিবাহ অনুষ্ঠানে এই গান পরিবেশনার রীতি প্রচলিত। লোকায়ত দেব-দেবীর কাহিনি এই

গানের বিষয়বস্তু। প্রচলিত মঙ্গল পানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতকে এসে বাংলাগান খণ্ডগীতি আকারে একটি স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। এই শতকের প্রধান দুটি
গীতধারা, শাক্তগীতি ও টপ্পা। মঙ্গল গান রচয়িতা রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের হাতে শাক্ত পদাবলির
সূত্রপাত। কিন্তু এর রূপটি উৎকর্ষিত হয়েছে রামপ্রসাদ সেনের হাতে। শাক্তপদাবলি, শাক্তগীতি মূলত শক্তি
দেবী শ্যামা এবং দুর্গা (উষা) কে নিয়ে রচিত। শ্যামাসংগীত, শ্যামার করাল, ভয়াল রূপের বিপরীতে তাঁর শেহ
বৎসল মাতৃরূপ কল্পনা করে মাতৃভক্তির পান। অন্যদিকে উমাসংগীতে, উমাকে (দুর্গা) সন্তান কল্পনা করে।
বাৎসল্যের গান।

অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে টপ্পা গানের মাধ্যমে রামনিধি গুপ্ত (নিধু বাবু) কেবল নতুন গীতরীতির অবতারণা
করেননি বরং বাংলা গানে আনেন মানবীয় অনুভূতির প্রকাশ। পূর্ববর্তী বাংলা গানে দেখা যায় ধর্ম
সম্প্রদায়ভিত্তিক দেবমাহাত্ম্য ও ভক্তির প্রকাশ। নিধুবাবুর টপ্পা সেদিক থেকে নর-নারীর প্রেমানুভূতির
প্রকাশক নিধুবাবু প্রায় ছয়শত টপ্পা সুরের প্রেমসংগীত রচনা করেন। সমকালের আরেক গীতধারা আখড়াই
গানের নব প্রবর্তনেও নিধুবাবুর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। টপ্পার সুর কবিগান, আখড়াই, পাঁচালী, যাত্রা ইত্যাদি
সমকালের অন্যান্য গীতধারাকে প্রভাবিত করেছিল। বাংলা টপ্পাপানে নিধুবাবু ছাড়া আর যার নাম বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন কালী মীর্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায় ।

উনিশ শতকের অন্যান্য গীতধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— পাঁচালী, কবিগান, যাত্রা ইত্যাদি। পাঁচালী,
পৌরাণিক গল্প ও লৌকিক উপকথাকে আশ্রয় করে আখ্যানভিত্তিক কিংবা গল্পভিত্তিক পরিবেশনায় একজন
পাঁচালীকার থাকে। তার সাথে থাকে যন্ত্রী এবং দোহার। পাঁচালীকার গল্পটি অভিনয় সহযোগে গানে গানে
পরিবেশন করেন। দোহারগণ গানের কথোপকথন, গান, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে গল্পের চরিত্র চিত্রণে
সহযোগিতা করেন। উনিশ শতকের উল্লেখযোগ্য পাঁচালীকার ছিলেন দাশরথি রায়।

কবি গান মূলত দুইজন স্বভাবকবির গান ও কাব্যের লড়াই। কবির লড়াইয়ে একেক দলে প্রধান গায়কের সাথে
একজন বাঁধনদার (কাব্য রচনার সহায়ক) এবং যন্ত্রীদল থাকেন। একজন কবিয়াল কাব্যে, গানে প্রশ্ন করেন,
যাকে চাপান বলা হয় এবং অপর কবি উতোর অর্থাৎ উত্তর দেন। কবিগানে রাতব্যাপী চলে এই চাপান
উভোরের পালা। আসর শেষে সুর ও কাব্যের উৎকর্ষতার ভিত্তিতে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়। উনিশ শতকের
উল্লেখযোগ্য কবিয়ালদের অন্যতম, ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, গোজলা এই এবং এন্টনি ফিরিঙ্গি।

উনিশ শতকের শুরুতে বাংলাসংগীতে 'ব্রহ্মসংগীত' নামে নতুন এক অধ্যাত্মগীতির (ভক্তিগীতি) সূচনা করেন
রাজা রামমোহন রায়। সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন কুসংস্কারভিত্তিক ধর্মচর্চার পরিবর্তে
একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের প্রচলন করেন। হাজার বছরের আচরিত সংস্কারভিত্তিক ধর্মচর্চার বিপরীতে ব্রাহ্মধর্মের
প্রচারে প্রধান মাধ্যম হিসেবে গানকে আশ্রয় করেন রামমোহন রায়। পূর্বতন সম্প্রদায়নির্ভর, পৌগুলিক

ধর্মসংগীতের তুলনায় অসাম্প্রদায়িক, অপৌত্তলিক, একেশ্বরবাদী এই নতুন ভক্তিগীতি শিক্ষিত বাঙালির মনে
স্থান করে নেয়। সুরের দিক থেকে রামমোহন রচিত প্রথম দিককারই একটি টপ্পাশ্রিত গান ছাড়া ব্রাহ্মসংগীত
মূলত হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ সুরে রচিত। প্রথম যুগের ব্রাহ্মসমাজে পায়কগণ ছিলেন বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদীশৈলীর
সংগীতজ্ঞ। আদি ব্রাহ্মসমাজ ক্রমে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ এবং নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে তিন ধারায় বিভক্ত হয়।
তিন ধারাতেই ব্রহ্মসংগীতের চর্চা অব্যাহত থাকে। ব্রহ্মসংগীতের ধ্রুপদী ধারার পাশে বাংলার লোকসুর ও
কীর্তনসুর যুক্ত হয়। তবে ব্রহ্মসংগীতের প্রধান চর্চাস্থল হিসেবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি স্বীকৃত। রামমোহনের
পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায়, তাঁর পুত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিপৃষ্ঠ হয় ব্রহ্মসংগীত এবং
রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে এই সংগীতধারা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

আবহমান কালের বাংলাগান নাট্য ও সংগীতের পরিপুরকতায় বেড়ে উঠেছে। পলাশীর যুদ্ধের পর অষ্টাদশ
শতকের শেষার্ধে ইংরেজ শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্যে কোলকাতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে
পরিবর্তনের ছোয়া লাগে। ইউরোপীয় ক্লাব প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে থাকে অপেরা। ক্রমে এই অপেরাথিয়েটার
প্রভাবিত করে বাংলাসংগীত সংস্কৃতিকে। নাট্যগীতি ও গীতিনাট্য নামে দুটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়। এ
সময়ে নাট্যগীতি ও গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নাম- গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিনোদবিহারী দত্ত, অতুলকৃষ্ণ মিত্র
ইত্যাদি।

উনিশ শতকের গানের অপর ধারা স্বদেশি সংগীত বা দেশাত্মবোধক গান। বাংলা সাহিত্যে স্বাদেশিকতা,
জাতীয়তাবোধ উনিশ শতকের প্রারম্ভে শুরু হলেও দেশপ্রেমের গান স্বাদেশিক সংগীত বিকশিত হয়। মূলত
১৯৬৭ সালে 'হিন্দুমেলা' ও 'সঞ্জিবনী' সভাকে আশ্রয় করে। স্বাদেশিকতা নিয়ে এই গান ফল্গুধারার মতো পুনরায়
প্রবাহিত হয় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।

এর পরবর্তী সময় পঞ্চকবির যুগ বলে আখ্যায়িত। বাংলাগানের পঞ্চভাম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,
রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম কথা ও সুরের পরিপূরকতায় এক নতুন ধারার
সূচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের বাংলাগানের পথ চলা।

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ শাখা লোকসংগীত। বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি।
এদেশের মানুষ যখন থেকে বাংলা ভাষা পেয়েছে তখন থেকেই লোকসংগীত রচিত ও গীত হয়ে আসছে।
এগারো শত বছর আগে রচিত 'চর্যাপদ' ছিল বাংলাসংগীত ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন। ভাষাও ছিল আদি
বাংলা। শ্রুতি ও স্মৃতি নির্ভর এসব রচনার ভাষায় প্রাচীনতাও রক্ষিত হয়নি। নাথগীতিকা, ময়মনসিংহ গীতিকা
ও পূর্ববঙ্গ গীতিকাগুলি মধ্যযুগের রচনা। চর্যাপদে ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে উল্লেখ আছে এমন অনেক প্রবাদ আজও
প্রচলিত। যেখানে লোকসংগীতের অনুসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়।

লোকসংগীতের সংজ্ঞ

সাধারণ অর্থে জনশ্রুতিমুলক গানকে লোকসংগীত বলা হয়। অর্থাৎ, যে গান শ্রুতি এবং স্মৃতি নির্ভর করে
প্রবহমান নদীর ধারার মতো বয়ে চলে তাকে লোকসংগীত বলে। এই গানে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না
ইত্যাদি অতি সহজ কথা ও সুরে প্রকাশ হয়ে থাকে। ড. আরতোষ ভট্টাচার্যের মতে “যাহা একটি মাত্র ভাব
অবলম্বন করিয়া গীত হইবার উদ্দেশ্যে রচিত ও লোকসমাজ কর্তৃক মৌখিক প্রচারিত হয়, তাহাকেই
লোকসংগীত বলে।" বাংলাদেশের প্রতি অঞ্চলে এই গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলেছেন- “নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে যেমন- ছোটো বড়ো নদী-নালা স্রোতের জাল বিছিয়ে

দিয়েছে, তেমনি বয়েছিল গানের স্রোত নানা ধারায়.... লোকসংগীতের এত বৈচিত্র্য আর কোনো দেশে আছে
কিনা জানিনে।" লোকসংগীতের সংজ্ঞা অনুযায়ী কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:

লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্য

১। কৃষিজীবী জনমানস থেকে স্বতঃউৎসারিত এক প্রাচীন গীতরীতি যা মৌখিকভাবে প্রচলিত লোকসমাজে।
২। এই প্রাচীন গীতরীতি যা বর্তমানকাল অবধি বহমান থাকে তাকে 'লোকসংগীত বলা হয়। যা রাগসংগীত

বা জনপ্রিয় আধুনিক সংগীত দ্বারা প্রভাবিত নয়।

৩। লোকসংগীত সমবেত কণ্ঠে গীত হয় যেমন; তেমনি একক কণ্ঠেও গীত হয়।
৪। এখানে পল্লি মানুষের সহজ ভাষা, আঞ্চলিক উচ্চারণ ও সহজ সুরের প্রকাশ।

৫। সম্মিলনে হৃদয়গ্রাহী কথা ও সুরের আবেদন।

৬। সুরের আবেদন সার্বজনীন হলেও কিছু কিছু গান আঞ্চলিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভাই এ গানগুলোকে
আঞ্চলিক গানও বলা হয়।

৭। প্রাকৃতিক নির্ভরতা অর্থাৎ নিসর্গ প্রান্তর, নদী ও নৌকা প্রভৃতি গ্রাম সভ্যতার রূপক এই গানে ব্যবহার হয়ে থাকে।

৮। জগৎ-জীবন ও দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার নিরাভরণ প্রকাশ।

৯। সহজ স্বাভাবিক ছন্দের ব্যবহার।

১০। মানবিক প্রেমের বিরহ-মিলিতজাত ভাবাবেগের প্রবল উচ্ছ্বাস।

বাংলাদেশের লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা তুলে ধরা হলো:

চটকা গান

চটকা মূলত ভাওয়াইয়া পানের অন্তর্গত। চটুল বাণী ও চটুল সুরে এবং দ্রুত লয়ে গাওয়া হয় বলে এটাকে চটকা
গান বলা হয়। তবে ভাওয়াইয়া গানের মতো এই গানেও গলার ভাঙা অলঙ্কার থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁন্দ।

গম্ভীরা

বৃহত্তর রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই গান প্রচলিত গম্ভীরা গানের বিষয়বস্তু মূলত বিনোদনমূলক
লোকসংগীত। এটি দলীয় সংগীত, তবে মূখ্য ভূমিকা পালন করে 'নানা' ও 'নাতি' নাম ভূমিকায় দুজন শিল্পী।
হারমোনিয়াম, ঢোল, দোতারা, বাঁশি, খঞ্জনী এবং করতাল বাজিয়ে অন্যান্য বাদক সাহায্য করে। গম্ভীরা গানের
একটি উদাহরণ:

হে নানা বড়োর জ্বালা যেমন তেমন ছোটোর জ্বালায় বাঁচিনা...।

ভাদু

পূজা উপলক্ষের গান। ভদ্রেশ্বরী দেবীকে উপলক্ষ করে সারা ভাদ্র মাসে এই গান গাওয়া হয়। মূলত ভাদুর
আগমনী উপলক্ষেও এ গান গীত হয়। তেমনি একটি গান:

আমার ভাদু দক্ষিণ যাবে

ক্ষিদে লাগলে খাবে কি

আনো ভাদু গায়ের গামছা.....।

আলকাপ

আলকাপ মিশ্র আঙ্গিকের গান। এতে বাদ্য, গান, নাচ, অভিনয় ও কৌতুকের সংমিশ্রণ আছে। এজন্য আলকাপ
গানের দল প্রায় ১৫-২০ জনের শিল্পী দল গঠিত হয়। দলের প্রধান গান রচনা ও গাইতে পারেন। আলকাপ
গানের শিল্পীরা সকলেই গ্রাম গঞ্জের সমাজের সকল স্তর থেকে আসে। আলকাপ গানের আসর বসে
পূজা মণ্ডপে, খোলা মাঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বনেও এ গান পরিবেশিত হয়। এই গান টাপাইনবাবগঞ্জ
জেলায় প্রচলিত। আলকাপ গানের একটি উদাহরণ-

বাংলা মা তোর আকাশ মাটি হলো।

তোর গতর হতে এই মাটিতে সুবাস বহে চিরকাল

বিয়ের গান

বিয়ের গান উৎসবের গান। এটি শুধু সামাজিক জীবনের উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক গান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে
সমাজভুক্ত সকলেই এই গানে অংশ গ্রহণ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে পানচিনি, গায়ে হলুদ ইত্যাদি
অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে গান পরিবেশন করা হয়। উল্লেখযোগ্য একটি বিয়ের গান:

সোনার বরণী কন্যা

সাজে নানান রে
কালো মেঘ যেন সাজিলরে

Content added || updated By
Promotion